
এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ এক ধরনের ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আজও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। রাজনীতিতে কোনো অনুশোচনা নেই; একাত্তরের সেই কালো অধ্যায়ের ধারাবাহিকতাই তাদের আরো জোরালো করেছে। কয়েক মাস আগে ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত ছাত্রশিবিরকে তাদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয়। আগস্ট মাসে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চিহ্নিত রাজাকারদের ‘শহীদ’ ও জাতীয় বীরের পরিচয় দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রদর্শনীও করে। শিক্ষার্থীসমাজ এবং বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের তীব্র প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষ পর্যন্ত সেই কলঙ্কজনক প্রদর্শনী সরাতে বাধ্য হয়।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি মূলত সুযোগ ও সুবিধার জন্য; তারা নারীমুক্তি, সমান অধিকার বা প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। একাত্তরকে চব্বিশ দিয়ে ঢেকে দিতে চায় তারা। মূলত একাত্তর ও চব্বিশ আলাদা বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটির তুলনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যুক্তিবাদী চিন্তা-ভাবনা, ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা, সমান অধিকার ও বৈচিত্র্যে তারা বিশ্বাস করে না। তারা একটি একরঙা, বৈচিত্র্যবিহীন, রুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মর্যাদা, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ও সবার বাংলাদেশ দর্শনের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। গুপ্ত রাজনীতি, অপরাজনীতি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক দেশের জন্য ভালো হতে পারে না।
এই প্রজন্মকে এই গুপ্ত রাজনীতির অপকৌশল থেকে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। একাত্তর আমাদের পরিচয়, আমাদের অস্তিত্ব—এটি স্বীকার করে ব্যর্থতাগুলোকে সফলতায় রূপ দিতে চব্বিশ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ একাত্তরকে রক্ষার জন্যই এই প্রজন্ম চব্বিশে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছে। শিবিরের গুপ্ত অপকৌশলকে নিরর্থক করার শক্তি এই প্রজন্মের মধ্যে নিহিত। তারা যথাসময়ে সঠিক জবাব দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন আজ এক গভীর চক্রান্ত ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ১৬ বছর ধরে এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। তবু সেই স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদ উত্খাতের মূল ভূমিকায় ছিল তারা। আগামী সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক, যাঁদের জীবনদান ও লড়াইয়ের কারণে আজ বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত। এই প্রজন্মই আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাদের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বই ভবিষ্যতের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান নতুন আশা সঞ্চার করেছে, যা দেশের রাজনৈতিক চেতনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই চেতনাকে ধারণ করেই বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এগিয়ে চলেছে। তাদের কর্মসূচি জনগণের মৌলিক চাহিদা, অধিকার ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দিচ্ছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির কাঠামো পরিবর্তন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সুরক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রে এই কর্মসূচি নতুন জীবনব্যবস্থার সূচনা করতে চায়।
একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং চব্বিশের পরিবর্তনের অঙ্গীকার—এই দুই সময়ের একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধ তৈরি হবে। এটি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং প্রজন্মান্তরের আশাপূরণের সংকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম সম্পাদক, কালের কণ্ঠ
প্রিন্ট